ডেস্ক রিপোর্ট:
ধরুন, আপনি সমুদ্র তীরে দাঁড়িয়ে বিশাল ঢেউয়ের গর্জন শুনছেন এবং নোনা জলে পা ভেজাচ্ছেন। এমন সময় আপনার পায়ের কাছে ভেসে আসলো একটি দলাকৃতির বস্তু। পরক্ষণেই আপনি জানতে পারলেন, এটি তিমির বমি। এটি এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই, কারণ এর দাম কোটি টাকার বেশি!
এটি শুনতে অবাক লাগলেও, সমুদ্রের বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির বমির দাম কোটি টাকার বেশি। দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তিমির বমিকে “ফ্লোটিং গোল্ড” বা ভাসমান সোনা বলা হয়।
আন্তর্জাতিকভাবে তিমির বমির নাম অ্যাম্বারগ্রিস। ফরাসি শব্দ “অ্যাম্বার” আর “গ্রিস” মিলে ইংরেজি “অ্যাম্বারগ্রিস” শব্দটি এসেছে। মূলত, স্পার্ম তিমির পেটে তৈরি হয় এই অ্যাম্বারগ্রিস। কালোবাজারে অ্যাম্বারগ্রিসের চাহিদা প্রচুর, যার কারণে এর পাচারে আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত।
সম্প্রতি কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে ৮ কেজি ৩৯৮ গ্রাম তিমির বমি সহ এক যুবককে আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। অভিযানে জব্দ করা তিমির বমির আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ২১ কোটি টাকা বলে জানিয়েছে বিজিবি। এ তথ্যটাই কৌতূহল জাগায়। তাহলে তিমির বমি জিনিসটা আসলে কী এবং এর এত চড়া দাম কেন?
টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ বাজারপাড়া সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারে পাচারের চেষ্টা করা হয় ওই তিমির বমি। কক্সবাজারের রামুর বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটে পরীক্ষার পরই নিশ্চিত হওয়া যায় বস্তার মধ্যে থাকা জব্দ হওয়া চালানটি অ্যাম্বারগ্রিসের।
অ্যাম্বারগ্রিসের অতি উচ্চমূল্যের কারণে এটিকে “ফ্লোটিং গোল্ড” বা ভাসমান সোনা বলা হয়। এটি স্পার্ম হোয়েল বা ক্যাশালট থেকে উৎপাদিত হয়। মানুষ বহু আগে থেকেই এটি ব্যবহার করে আসছে, তবে এর উৎস ছিল অজ্ঞাত। এমনকি ১৭ লাখ ৫০ হাজার বছরের পুরোনো ফসিলের নমুনাও পাওয়া গেছে অ্যাম্বারগ্রিসের।
কিন্তু এই বস্তুটি আসছে কোথা থেকে, তা নিয়ে নানা তত্ত্ব ছিল। কেউ ভাবছিলেন এটি সমুদ্রের ফেনার কঠিন রূপ, কেউ আবার বলছিলেন এটি বিশাল কোনো পাখির মল।
যুক্তরাজ্যের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম সূত্রে জানা যায়, রহস্যময় পদার্থটির উৎস সম্পর্কে মানুষের ধারণা প্রথম পরিষ্কার হয় ১৮ শতকের গোড়ার দিকে, যখন বিপুল পরিমাণ তিমি শিকার শুরু হয়। তিমির বমি বা অ্যাম্বারগ্রিসগুলো কখনো কখনো ভাসমান অবস্থায় সাগরে ভেসে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়।
ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের আরও তথ্য অনুযায়ী, তিমির খাবারের একটি বড় অংশ স্কুইড জাতীয় প্রাণী থেকে আসে। তিমিরা অপাচ্য বা হজম না হওয়া বেশিরভাগ অংশ বমি করে দিলেও কিছু অংশ অন্ত্রে প্রবেশ করে এবং একসঙ্গে লেগে থাকে। ধীরে ধীরে এটি একটি কঠিন অ্যাম্বারগ্রিসের পিণ্ডে পরিণত হয় এবং বছর ধরে জমতে জমতে আকারে বড় হয়।
তবে অ্যাম্বারগ্রিসের দাম এত বেশি কেন? এর দুষ্প্রাপ্যতা এবং সুগন্ধি তৈরিতে ব্যবহারই একে এতটা মূল্যবান করে তুলেছে। এর ঘ্রাণ বিভিন্ন রকম হতে পারে, কখনো কস্তুরির সঙ্গেও মিল পাওয়া যায়।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের মতে, যদি পারফিউম তৈরির কারখানায় সুগন্ধ বেছে নেওয়ার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি গন্ধ পছন্দ করেন, তবে অ্যাম্বারগ্রিসের প্রতি আউন্স মূল্য কয়েক হাজার ডলার হতে পারে।
কখনো অ্যামব্রেইন নামক গন্ধহীন অ্যালকোহলের কারণে এটি আরও মূল্যবান হয়ে ওঠে। অ্যাম্বারগ্রিস থেকে এই অ্যালকোহল বের করা হয়, যা পারফিউমের সুগন্ধ দীর্ঘস্থায়ী করতে ব্যবহৃত হয়। অ্যাম্বারগ্রিসের রঙ দেখে এর মান নির্ধারণ করা যায়; সাধারণত সাদা অ্যাম্বারগ্রিস থেকে সেরা মানের পারফিউম তৈরি করা হয়।
পারফিউম প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান শেইমেনের মালিক নভেম্বার নিকোলাস বলেন, “এটি একটি অত্যন্ত মূল্যবান পদার্থ, যা তার অনন্য গন্ধ এবং সংরক্ষণকারী গুণাবলির জন্য পরিচিত। এটি যুক্ত করা হলে সুগন্ধ আরও গাঢ় ও স্থায়ী হয়।”
নিকোলাস আরও বলেন, “অ্যাম্বারগ্রিস তীক্ষ্ণ বস্তু (যেমন—স্কুইডের ঠোঁট) থেকে তিমির অন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য উৎপাদিত হয়। একপর্যায়ে তিমি এটি উগরে দেয়, তখন সমুদ্রে ভাসতে বা উপকূলের কাছে দেখা যায়।”
তবে কীভাবে পদার্থটি সমুদ্রে অবাধে ভাসতে থাকে, তা নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, তিমি এটি মলের সঙ্গে ছেড়ে দিতে পারে। অন্যদিকে, কিছু বিজ্ঞানী বলেন, এটি এত বিশাল হয়ে যায় যে এর কারণে মলদ্বার ফেটে গিয়ে প্রাণীটির মৃত্যুও হতে পারে।
স্পার্ম হোয়েল বা তিমিরা সারা বিশ্বে বাস করে, যার ফলে অ্যাম্বারগ্রিস যেকোনো সাগর-মহাসাগর বা বেশিরভাগ উপকূলে ভেসে থাকতে দেখা যায়। তবে বাস্তবে তা হয় না এবং খুব কম তিমির মৃতদেহে অ্যাম্বারগ্রিস মেলে।
আঠারো শতকে বিপুল পরিমাণে তিমি শিকার শুরুর আগে বিশ্বে ১১ লাখ স্পার্ম তিমি ছিল। বর্তমানে মাত্র ৩ লাখ অবশিষ্ট আছে। তাই তিমি শিকারের উৎসাহিত করার কারণে অনেক দেশে অ্যাম্বারগ্রিসের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও এটি নিষিদ্ধ।
এদিকে কক্সবাজারে অ্যাম্বারগ্রিস উদ্ধারের পর বিজিবি জানায়, তিমির বমি হিসেবে পরিচিত অ্যাম্বারগ্রিসের বিক্রি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ হয়ে অ্যাম্বারগ্রিসের চোরাচালান বিরল ঘটনা।
কিন্তু মন মাতানো সৌরভ ছড়ানো ফরাসি সুগন্ধি তৈরিতে অ্যাম্বারগ্রিস এখনো একটি সাধারণ উপাদান। ফ্রান্স ছাড়াও ইংল্যান্ডসহ আরও কিছু দেশে এর বিপণন বৈধ।
ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর কিউরেটর রিচার্ড সাবিন বলেন, “তিমি এখন বিশ্বজুড়েই সংরক্ষিত। তবে ভবিষ্যতে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। অ্যাম্বারগ্রিসের সিনথেটিক বিকল্প পাওয়া যায় এবং এটি ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া উচিত। তাহলে মানুষের মধ্যে তিমি থেকে সম্পদ আহরণের চিন্তাটা দূর হবে।”
এটি অনুমান করা হয় যে, শুধুমাত্র ১ শতাংশ তিমি অ্যাম্বারগ্রিস এভাবে বের করে দিতে সক্ষম। দুষ্প্রাপ্যতার কারণে এটি এত দামি হয়েছে। আবার মানভেদে কেজিপ্রতি অ্যাম্বারগ্রিসের দাম হতে পারে কয়েক লাখ টাকা থেকে দেড়-দুই কোটি টাকা।
২০২৩ সালের জুলাইয়ে এক অধ্যাপক একটি মৃত তিমির অন্ত্রে অ্যাম্বারগ্রিসের একটি পিণ্ড খুঁজে পান, যার আনুমানিক মূল্য সাড়ে পাঁচ লাখ ডলার। স্পেনের দ্বীপ লা পালমার সৈকতে সাগরের প্রবল ঢেউয়ে একটি মৃত তিমি ভেসে আসে। অন্তোনিও ফার্নান্দেজ নামের ওই অধ্যাপক তিমিটির মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। ইউনিভার্সিড দে লাস পালমাস ডি গ্রান ক্যানারিয়ার ইনস্টিটিউট অব অ্যানিমেল হেলথ অ্যান্ড ফুড সিকিউরিটির প্রধান ফার্নান্দেজ তিমিটির মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে নামেন এবং তখনই আবিষ্কার করেন, প্রাণীটির অন্ত্রে আটকে ছিল ২১ পাউন্ড ওজনের একটি পিণ্ড। প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ ডলারের এই পিণ্ড অ্যাম্বারগ্রিসের তৈরি।
বিবিসি জানিয়েছে, ২০২১ সালে এডেন উপসাগরে একদল জেলে আরব আমিরাতের এক ব্যক্তির কাছে ১৫ লাখ ডলারে অ্যাম্বারগ্রিসের একটি পিণ্ড বিক্রি করেন। এতে যে লাভ হয়, তাতে ৩৫ জেলের সবাই বাড়ি, গাড়ি এবং নৌকা কিনে ফেলেন।