কুমিল্লার ১৪টি উপজেলা বন্যার কবলে পড়েছে। স্মরণকালের ভয়াবহতম বন্যা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে কুমিল্লা। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলো হলো বুড়িচং, নাঙ্গলকোট, চৌদ্দগ্রাম এবং ব্রাহ্মণপাড়া। বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়ার অন্তত আড়াই শতাধিক গ্রাম গোমতী ও সালদা নদীর ভাঙনের কারণে পানির নিচে চলে গেছে। দেবিদ্বারও ডুবছে। লাকসাম, মনোহরগঞ্জ এবং তিতাস উপজেলাগুলোর বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।
বন্যায় প্রাণহানি বাড়ছে। নদীর ভাঙনে বহু বাড়িঘর, কৃষি জমি ও মাছের প্রকল্প ধ্বংস হয়ে গেছে। হাঁটলে পানির নিচে রাস্তার ইট-সুরকি অনুভব করা যাচ্ছে। মাত্র এক সপ্তাহ আগে যাদের সবকিছু ছিল, তারা এখন অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। বহু মানুষ তাদের সাধের বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু এলাকায়, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিচ্ছেন।
সরকারি তথ্যমতে, বন্যায় দুই শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে এবং প্রায় সাড়ে ৯ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় ৬৭ হাজার মানুষ। বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী, এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। স্থাপনা ও সড়কের ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ পানি নামার পর জানা যাবে, তবে যে কোনো সময়ের রেকর্ড ছাড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত তিন দিনে বন্যাকবলিত এলাকায় একটাই চিত্র দেখা যাচ্ছে—দলে দলে মানুষ প্লাবিত এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। হাঁটু বা কোমরসমান পানিতে ভিজে তারা নিরাপদ স্থানে যাচ্ছেন। তবে যারা বাড়িঘরের মায়া ত্যাগ করতে পারছেন না, তারা জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলছেন বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকর্মীরা।
বিদ্যুৎ না থাকায় বিভিন্ন এলাকার মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, ফলে দুর্গত এলাকার খবর নেওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। সময় যত গড়াচ্ছে, বাঁধের ভাঙনও তত বড় হচ্ছে। নদীর পানি উচ্চতা কমলেও প্রবল গতি নিয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। বিভিন্ন এলাকায় সর্বনিম্ন ৩ ফুট থেকে সর্বোচ্চ ১৫ ফুট পর্যন্ত পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বুড়িচং উপজেলার দুর্গত এলাকার মানুষজন বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধের সংকটে ভুগছেন। তারা নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য আকুল আবেদন জানিয়েছেন। ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার পরিস্থিতিও একই রকম।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দুর্গত এলাকায় খাবারের অভাব নেই, তবে সুষম বণ্টন এবং খাবার বিতরণের সমস্যা রয়েছে। অনেক পরিবার পানিতে আটকে আছে। বিভিন্ন সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবীরা স্পিডবোট দিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
এদিকে, বুড়িচং উপজেলার গোপীনাথপুরের ৬০ বছর বয়সী ফরিদ মিয়া পানিতে আটকা পড়ে মারা গেছেন। বাড়িতে পানি উঠায় পার্শ্ববর্তী মেয়ের বাড়ি রামনগরে আশ্রয় নিয়েছিলেন, কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার অভাবে তার মৃত্যু হয়।
রোববার দুপুরে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) তার মরদেহ উদ্ধার করে। একই সময়ে আগানগর এলাকা থেকেও আরেকটি ভাসমান মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
তিতাস উপজেলার বাঘাইরামপুর গ্রামে দুই মাদ্রাসাছাত্রী সড়ক ভেঙে বন্যার স্রোতে ভেসে গিয়ে মারা গেছে। নাঙ্গলকোট উপজেলার সাতবাড়িয়া, বক্সগঞ্জ, ঢালুয়া ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। মনোহরগঞ্জ ও লাকসাম এলাকাতেও বন্যার্তদের ত্রাণ সহযোগিতা প্রয়োজন।
স্বেচ্ছাসেবকরা জানিয়েছেন, যে সব এলাকা প্লাবিত হচ্ছে, সেখানে ত্রাণ সহায়তার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবেদ আলী জানান, জেলার ১৭টি উপজেলায় সরকারিভাবে ৬০০ মেট্রিক টন চাল এবং ৩৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পারিপার্শ্বিক কারণে বুড়িচং উপজেলায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে নৌযানের অভাবে ত্রাণ পৌঁছাতে সমস্যা হয়েছিল, এখন বিভিন্নভাবে নৌযানের ব্যবস্থা হচ্ছে। যে সেংকট তৈরি হয়েছে তা সমাধান হচ্ছে। এখন সবাই ত্রাণ পাচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান জানায়, গেল কয়েকদিন থেকে গোমতির পানি কমেছে। সর্বশেষ রোববার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত গোমতি নদীর পানি বিপদসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।